বাংলাদেশ

ঢাকা সেনানিবাসে বিক্রম মিশ্রি’র বৈঠক নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি এই সফরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তার এই সফর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কারণ তার এই সফর এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হয় যখন ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

তবে এই সফরে তিনি গণমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে ঢাকা সেনানিবাসে একটি বৈঠকে অংশ নেন। যা নিয়ে ঢাকা ও দিল্লিতে গুঞ্জন রটে যায়। তবে এই বিষয়ে কোনো গণম্যাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়নি। এবার ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক মানবজমিনের (জনতারচোখ) অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে বিষয়টি জানা যায়।

ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে বিক্রম মিশ্রি একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। সে সময় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও বৈঠকটি হয় তার। যা নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে।

জানা যায়, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশ সফর নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল চারদিকে। ছিল নতুন নতুন গুজব। গত ৩ মাস ধরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যা ঘটেছে তা ৫২ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কেন এমনটি হলো? ভারতকে তো বাংলাদেশের মানুষ বন্ধু-জ্ঞান করে।

’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ৫ই আগস্ট বাংলাদেশে রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর ভারতের সেই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। ঠুনকো কিছু ঘটনা নিয়ে শোরগোল ফেলে দিলো ভারতীয় মিডিয়া।

একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করানো হলো। সবই হলো রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টার্গেট করে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা হচ্ছে এমন একটা সুর তুলে সীমান্তের ওপারে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানো হলো। রক্ষা পেলো না বাংলাদেশের মিশনও। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় বাক্যবাণে বাংলাদেশের গায়ে কালিমা লেপনের চেষ্টা করলেন!

শান্ত এই ভূমিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী পাঠানোর প্রস্তাবও করে বসলেন। হ্যাঁ এটা সত্য যে, ৩৬ জুলাই খ্যাত ৫ই আগস্ট বদলে দিয়েছে এই ব-দ্বীপের শাসন ব্যবস্থা তথা রাজনীতির হিসাবনিকাশ। দিল্লির সমর্থনে বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসা শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের শোচনীয় পতন হয়েছে ওই দিনে। জনরোষ থেকে প্রাণে বাঁচতে হাসিনা তার দুনিয়ার একমাত্র মিত্র ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন। তার প্রতি ভারতের ভালোবাসা নিখাদ। এটা প্রমাণিত। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশকে তারা পরিত্যক্ত ঘোষণা করবে? না, বোদ্ধাদের ভাষ্য মতে, এদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধন অকাট্য। সম্পর্কে টানাপড়েন হতেই পারে। যার প্রমাণ দিলো দিল্লি।

সব আলোচনা-সমালোচনা তথা সম্পর্কের চরম টানাপড়েনের মুহূর্তে ঢাকায় পা রাখলেন দিল্লির বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি। ভোরে দিল্লি থেকে দেশটির বায়ুসেনার বিশেষ চপারে উড়ে এলেন তিনি। দিনের শুরুতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই পররাষ্ট্র সচিব একান্ত বৈঠকে বসলেন। পরে বসলেন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বাৎসরিক, স্টক টেকিং বা স্ট্রাকচার্ড আলোচনায়। নাম ফরেন অফিস কনসালটেশন বা এফওসি। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা স্থায়ী ওই আলোচনা মধ্যাহ্নভোজের মধ্যদিয়ে শেষ হলো।

আনুষ্ঠানিক আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট বিস্তৃত আলোচনা হলো। সেখানে গুরুত্ব পেলো ভারতে বসে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি। বৈঠকে অবশ্য তাকে ফেরানো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। যদিও ঢাকায় এ নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। বৈঠক বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরতে পরবর্তীতে দুই পররাষ্ট্র সচিব আলাদা আলাদা ব্রিফ করলেন। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব একগাদা প্রশ্নের জবাব দিলেন। দিল্লির বিদেশ সচিব কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হলেন না।

মনে হলো তারা নিজ অবস্থানে অনড়! বৈঠক সূত্রে আগেই খবর বের হয়, বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন দিল্লির প্রতিনিধিরা। ঢাকার প্রতিনিধিরা ব্যাখ্যাসহ জবাব দেন। খোলাসা করে যেটা বলা হয় তা হলো- দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক ‘বন্ধুত্ব, ‘পারস্পরিক নির্ভরশীলতা’ এবং মাঝেমধ্যে ‘উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা’র মিশেলে হয়ে থাকে। এটাই বাস্তব।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যায় যখন বর্ডারে রক্ত ঝরে। তাছাড়া মানুষের সেন্টিমেন্টে লাগে এ সব ঘটনা যখন সামনে আসে। বিশেষত অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে যখন বড় করে দেখানো হয় এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সরকারি পর্যায়ে এটা নিয়ে যখন কথা বলা হয়। বাংলাদেশ সমস্যা অ্যাড্রেস করে এবং এ নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কূটনৈতিক চ্যানেলে বার্তা দিলেও মানুষের মধ্যে ক্ষোভের এতো সঞ্চার হতো না বলে মনে করে ঢাকা। আলোচনায় উভয়ের তরফেই বলা হয় বাস্তবতা অস্বীকার করার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরং এতে সমস্যা বাড়বে। তাই উভয়ের যৌক্তিক কনসার্ন যত দ্রুত অ্যাড্রেস করা যাবে, ততই মঙ্গল। সেগুনবাগিচায় কয়েক মিনিটের সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের অনুরোধ রেখে গেলেন ভারতীয় সচিব। ব্রিফিং শেষে চটজলদি বেরিয়ে গেলেন।

তখনো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক বাকি। ৪টা ৫ মিনিটে যমুনায় ঢুকলেন। ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎটি ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ পেলো দু’পাড়ে। কিন্তু এটা খুব রহস্য যে, সন্ধ্যার আগে সরকারি সব কর্মসূচি শেষ করা দিল্লির বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি পরবর্তী ক’ঘণ্টা কোথায় কি বৈঠক করলেন। বিশেষ করে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ থেকে ৮টা ৩৫ পর্যন্ত এই এক ঘণ্টা কোথায় ছিলেন তিনি। কার সঙ্গে দেখা করলেন তিনি ও তার দু’জন সফরসঙ্গী।

ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে বিক্রম মিশ্রি একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ কাম বৈঠকটি হয় তার। সেই বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে জানা ও বুঝার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, সেনানিবাসস্থ বাসভবনে সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল সেনাপ্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সেই সাক্ষাৎ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীলরা পরবর্তীতে বিস্তারিত অবহিত হয়েছেন।

যেটুকু জানা গেছে সম্পর্কে মেঘ দূর করার বিষয়ে ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষত দূরে থেকে বিদেশ সচিব বা দিল্লি যা ভাবছিল বাংলাদেশ সফর করে একটি ইতিবাচক ধারনা নিয়েই ফিরেছেন বিদেশ সচিব।

সোর্স: দৈনিক দিগন্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button